• 23 Chamelibagh, Dhaka-1217
  • +88-02-9333543
  • bfdrms@gmail.com
In Publication

‘সোনার বাংলা’ গড়তে হলে ‘দুর্নীতি’ দূর করতেই হবে?

‘সোনার বাংলা’ গড়তে হলে ‘দুর্নীতি’ দূর করতেই হবে?

মোনায়েম সরকার
বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে তার দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন এবং একের পর এক নেতাকে ধরে জেলে ভরছেন তাতে তার ভাবমূর্তি ও জনপ্রিয়তা দারুণভাবে বেড়ে গেছে। এই শুদ্ধ অভিযান দুর্নীতির শেকড় উপড়ে না ফেলা পর্যন্ত চলুকÑ এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।
বাংলাদেশ একটি গরিব রাষ্ট্র বলেই বিশ্বে পরিচিত। এই রাষ্ট্রের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার জীবদ্দশায় তিনিও সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ছিলেন এবং তার ২৭ জন এম.পি-কে পার্টি থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শক্ত হাতে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরেছিলেন বলেই তখনকার যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিল এবং জিডিপি সাড়ে সাত শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। দেশি-বিদেশি ঘাতক চক্রের চক্রান্তে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নির্মমভাবে নিহত হলে এদেশে আবির্ভূত হয় পুতুল সরকার এবং এই পুতুল সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা নেয় সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। তিনি বাংলাদেশে অবাধে দুর্নীতি করার সুযোগ তৈরি করে দেন।
জিয়াউর রহমান দেশবিরোধীদের রাষ্ট্রের মন্ত্রী বানিয়ে মুজিব কিলারদের মর্যাদাপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করে দুর্নীতিবাজদের পুনর্বাসন করেন বাংলাদেশে। এরপরেই আসেন আরেক দুর্নীতিবাজ সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ। তিনি দুর্নীতিতে এতটাই পারঙ্গম ছিলেন যে অল্পদিনেই তার প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে যান। জিয়াউর রহমান দুর্নীতির সঙ্গে সঙ্গে অবৈধ অস্ত্রের বিস্তারও ঘটান। এরশাদ সাহেব দুর্নীতির সঙ্গে ঢুকিয়ে দেন মাদক ও সন্ত্রাস। এরপরে ’৯০ সালে এরশাদের পতন হলে খালেদা জিয়া বাংলাদেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তিনি এবং তার পুত্রদ্বয় বাংলাদেশে দুর্নীতির এক মহোৎসব শুরু করেন। খালেদা পুত্র তারেক রহমান ও কোকোÑ দুর্নীতির জন্য বাংলাদেশে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তারেক রহমানের আশেপাশে যারা ছিলেন তারাও একেক জন দুর্নীতির রাঘব বোয়াল হয়ে উঠেছিলেন। এক্ষেত্রে গিয়াসউদ্দীন আল মামুনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। খালেদা জিয়ার আমলে ‘হাওয়া ভবন’ ছিল দুর্নীতির হেড কোয়ার্টার আর ‘খোয়াব ভবন’ ছিল মদ-মাস্তির বিনোদন কেন্দ্র। আজ বাংলাদেশের মানুষ দুর্নীতির যেসব চিত্র দেখতে পাচ্ছে সেগুলো মূলত জিয়া-এরশাদ-খালেদার শাসনামলেরই সৃষ্টি।
বন কেটে বসতি গড়া যেমন কষ্টকর, শেখ হাসিনা এখন সেই কষ্টটাই করছেন। তিনি একই সাথে বাংলাদেশকে বিশ্বের মধ্যে সম্মানজনক স্থানে দাঁড় করাবার চেষ্টা করছেন, অন্যদিকে পূর্বের দুর্নীতির শেকড় উপড়ে ফেলার মিশন হাতে নিয়েছেন। এই দুটো কাজই শ্রমসাধ্য এবং ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকি নিতে শেখ হাসিনা পছন্দ করেনÑ এমন প্রমাণ আমরা বহুবার তার কাছ থেকে পেয়েছি। ঝুঁকি নিতেই হবে। ঝুঁকি নিয়েই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি বর্বরদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন এবং বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন।
মুজিব কন্যা শেখ হাসিনাও একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়তে জীবন বাজি রেখে লড়াই করে যাচ্ছেন। এতদিন তিনি লড়েছেন প্রতিপক্ষ শত্রুর বিরুদ্ধে, আজ তিনি লড়াই করছেন নিজ দলীয়, ছদ্মবেশী, অর্থগৃধ্রু দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে। এই লড়াই নিঃসন্দেহে কঠিন লড়াই, কিন্তু এই লড়াইয়ে শেখ হাসিনা জয়ী হবেনÑ এমনটাই আশা করেন বাংলাদেশের ষোলো কোটি মানুষ।
একটি বেদনার কথা না বললেই নয়, সারা দেশে যখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালিত হচ্ছে, তখন একদল জ্ঞানপাপী ভ-ের উল্টাপাল্টা কথা শুনে আশ্চর্য হতে হয়। একদিন আমিও রাজনীতি করেছি। আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণের কিছুটা ক্ষমতা আমারও ছিল। আমার স্পষ্ট মনে আছে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার কিছু কায়দা-কৌশল আছে, অথচ আজকাল সরকারবিরোধীরা কি বলেন-না বলেন স্পষ্ট করে কিছুই বোঝা যায় না। এদের দেখে মনে হচ্ছে, এদের তত্ত্বজ্ঞানও নেই, এদের তথ্য জ্ঞানও নেই। এরা একজনেই একটি দল। এরা রাস্তায় দাঁড়ায় কিন্তু কোনো কর্মী থাকে না। এরা ছোট্ট ঘরে, নিজস্ব চেম্বারে প্রেস কনফারেন্স করে। সেই প্রেস কনফারেন্সে তাদের দুই একজন ছাড়া আর কাউকে দেখা যায় না। অথচ এই জনভিত্তিহীন পার্টির প্রধানগণ যখন পত্রিকায় বলেন দুর্নীতিবাজদের ধরা হচ্ছে, ধরে জেলে নেওয়া হচ্ছে কিন্তু রিমান্ড হচ্ছে না। আবার ওই পত্রিকায়ই যখন দেখি অমুক দুর্নীতিবাজের ২০ দিন রিমান্ড মঞ্জুর, তখন জনগণ ওই জ্ঞানহীন নেতার কা-জ্ঞান দেখে বিস্মিত হয়। বাংলাদেশে দুর্নীতি, খুন, বোমা, গ্রেনেড, মৌলবাদÑ এসবই এনেছে সামরিক সরকার ও তাদের উত্তরাধিকারীগণ। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার রক্তে কোনো দুর্নীতি নেই। শেখ হাসিনার চিন্তায় দুর্নীতির স্থান নেই, তিনি খুন, বোমা, গ্রেনেড, মৌলবাদ দিয়ে রাজনীতি করার পক্ষে নন। তিনি দেশ গড়তে চান, উন্নয়নের ম্যাজিক দেখিয়ে জনতার মনে সম্মানের আসন পেতে চান।
কথায় আছেÑ ক্ষমতা মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলে, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা মানুষকে নিরঙ্কুশভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলে। আজ সারা বিশ্বেই দুর্নীতি ব্যাধির আকারে রূপ নিয়েছে। অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানই দুর্নীতির দায়ে জেলে আছেন। সেই হিসাবে শেখ হাসিনার সরকার যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি নিয়ে দেশ শাসন করছেন। যাদেরকে বিশ্বাস করে তিনি দলীয় ক্ষমতায় বসিয়েছেন তিনিই আজ তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটা শুধু বাংলাদেশের জন্যই দৃষ্টান্ত নয়, সারা পৃথিবীর জন্যই অনন্য দৃষ্টান্ত। ক্ষমতাসীন সরকার কখনো কোনো দেশে এতটা কঠোরভাবে দুর্নীতি দমনে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন কিনা তা আমাদের অজানা। শেখ হাসিনা সরকারের এই প্রশংসাযোগ্য পদক্ষেপে বাংলাদেশের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। এ জন্য শেখ হাসিনা সরকারকে আমাদের ধন্যবাদ দিতেই হবে।
শেখ হাসিনা সরকারকে এখন ত্রিমুখী লড়াই করতে হচ্ছে। সরকারবিরোধী পক্ষের সঙ্গে লড়াই করার পাশাপাশি দুর্নীতিবাজ দলীয় নেতৃবৃন্দ এবং ক্ষুধামুক্ত উন্নত বাংলাদেশ গড়ার লড়াই করতে হচ্ছে। এতটা চাপ নিয়ে দেশশাসন করা আসলেই অনেক কঠিন কাজ। আজ পৃথিবীর অনেক দেশের প-িত-গবেষকগণই বলছেনÑ বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ অল্প সময়ের মধ্যেই উন্নত দেশে পরিণত হবেÑ এমন সব আশার বাণী আমাদের মনে প্রেরণার সঞ্চার করে। বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবেও আমরা এ জন্য গর্ববোধ করি।
যেভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হয়েছে, এ মনোভাব কিছুতেই পরিবর্তন করা যাবে না। কোনো চাপের মুখে বা কারো প্রতি প্রীতি দেখিয়ে ন্যায়-বিচার থেকে সরে আসা যাবে না। যারা ব্যাংকের টাকা ক্যাসিনো ভল্টে রেখেছে, যারা বিদেশে টাকা পাচার করেছে, সীমাহীন দুর্নীতি করে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছে, তাদের ব্যাপারে করুণা প্রদর্শন করা ঠিক হবে না। সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ দরকার। দুর্নীতিবাজদের, টেন্ডারবাজদের, জুয়াড়িদের দল থেকে বহিষ্কার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এমনকি দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ, কোনো মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী দুর্নীতিগ্রস্ত হলে তাদেরও শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিপরিষদের কেউ দুর্নীতিবাজ ছিলেন না, আমরা চাইÑ শেখ হাসিনার মন্ত্রিপরিষদও দুর্নীতিমুক্ত থাকুক।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার আগমন আশীর্বাদস্বরূপ। এক সময় বাংলাদেশ দুর্নীতিতে ক্রমাগত চ্যাম্পিয়ন হতো। আজ বাংলাদেশ সেই কলঙ্ক মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। কোনোভাবেই বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে নাÑ তাহলে ত্রিশ লক্ষ শহিদ আমাদের ক্ষমা করবেন না। নিন্দুকেরা যত কথাই বলুকÑ অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গেই দুর্নীতির এই অভিযানের সফল সমাপ্তি ঘটাতে হবে। দুর্নীতির কারণে শুধু আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে তাই নয়, সমাজে অস্থিরতাও তৈরি হচ্ছে। বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকা- দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতিরই কুফল। আমরা এমন নৃশংস হত্যাকা- কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। অতীতে এমন নৃশংস হত্যাকা- অনেক ঘটেছে। সেগুলোর সুষ্ঠু বিচার হলে আজ হয়তো আবরার হত্যাকা- আমাদের দেখতে হতো না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে আবরার হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচারের মুখোমুখি করা এটাও শুদ্ধি অভিযানের দৃষ্টান্ত বলে আমি মনে করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপর বাংলাদেশের সকলের আস্থা আছে। অপশক্তি যতই তার এগিয়ে চলার গতি রোধ করার চেষ্টা করুক না কেনÑ কিছুতেই তার অপ্রতিরোধ্য গতি থামানো যাবে না। দলে শুদ্ধ অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি প্রশাসনেও এ অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে এবং সৎ, যোগ্য, দেশপ্রেমিক মানুষদের দেশ সেবায় সম্পৃক্ত করতে হবে। তাহলেই আওয়ামী লীগ নিরাপদে থাকবে, তাহলেই বাংলা হবে সত্যিকারের সোনার বাংলা।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
১০ অক্টোবর, ২০১৯

Leave a Reply

Send Us Message

*

You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>